বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:৫৭ অপরাহ্ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর নিরঙ্কুশ বিজয় নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। প্রায় পাঁচ দশক পর সংগঠনটির নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই ফলাফলের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা, দ্বন্দ্ব ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আধিপত্য ভেঙে শিক্ষার্থীরা বিকল্প নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। ভোটের ফলাফল তারই প্রমাণ বহন করে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি চালানোর সুযোগ ছিল না।
বিভিন্ন আবাসিক হলে শিবির সন্দেহে মারধরের ঘটনা ঘটত প্রায়ই। এমনকি শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহে, শিবির ট্যাগিং দিয়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের হেনস্তার মুখোমুখিও হতে হয়েছে। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে ছাত্রশিবির। প্রকাশ্যে আসার এক বছরের মাথায় ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিশাল জয় পেল তারা।
ভিপি পদে মো. আবু সাদিক কায়েম ১৪,০৪২ ভোট পেয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন। জিএস ও এজিএস পদেও শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের সাফল্য একই বার্তা দিয়েছে। সম্পাদক পদের মধ্যে ৯টিতে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পদে জয়ী হয়ে ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্রমাণ করেছে- তারা শুধু একটি প্রান্তিক শক্তি নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ বিকল্প নেতৃত্ব।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো- ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। মোট ভোট পড়েছে ৭৫.৭৫ শতাংশ, যার মধ্যে মেয়েদের অংশগ্রহণ ৬৭.১২ শতাংশ এবং ছেলেদের অংশগ্রহণ ৮৪ শতাংশের ওপরে। এই ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ভোটার উপস্থিতি প্রমাণ করে, শিক্ষার্থীরা ডাকসু নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং পরিবর্তনের প্রতি আস্থা রেখেছে। বিশেষকরে প্রতিটি হলে নারী শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য; তাদের ভোটই ফলাফলের ভারসাম্য পাল্টে দিয়েছে।
ছাত্রদলের পরাজয়: ছাত্রদলের পরাজয়ও নিছক সংখ্যা বা পরিস্থিতির ব্যর্থতা নয়। আবিদুল ইসলাম খান, তানভীর বারী হামিম ও তানভীর আল হাদি মায়েদরা যোগ্যপ্রার্থী হলেও এবার তাদের ভরাডুবি হয়েছে। ছাত্রদলের উচিত নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতির গৎবাঁধা অভিযোগ বাদ দিয়ে ডাকসুতে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করা। নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ বাংলাদেশে পরাজিতদের ট্রাডিশনাল স্টেটমেন্ট। এই ট্র্যাডিশন থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এবার ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছিলেন যে ছাত্রদল নির্বাচিত হলে তারাও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মতো আচরণ করবেন, গণরুমণ্ডগেস্টরুম প্রথা আবার চালু করবেন। তবে এ দায় শুধু ছাত্রদলের একার নয়। গত এক বছরে সারা দেশে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অন্তর্কোন্দলসহ বিভিন্ন অপকর্মের প্রভাবও ক্যাম্পাস রাজনীতিতে পড়েছে। এখন ছাত্রদলের উচিত-ট্যাগিং, দায় দেওয়া ও পেশী শক্তির রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পালস বুঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি দিয়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলা। ‘যা ছাত্রলীগ তাই ছাত্রদল’ তরুণ ভোটারদের এই ধারণা পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে, পুরাতন ন্যারেটিভ, পুরাতন ধ্যান ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে ‘আদর্শের মোকাবিলায় প্রয়োজন উত্তম আদর্শ।‘
জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি বেশিরভাগ সময়ই জাতীয় রাজনীতিতে দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। ডাকসুর ফলাফল কেবল ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর প্রভাব পড়বে জাতীয় রাজনিতিতেও। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এখানকার নেতৃত্ব বারবার জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গড়ে ওঠা নেতৃত্বই বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বই, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেদিক থেকে শিবির-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর নিরঙ্কুশ বিজয় জাতীয় রাজনীতির জন্য একটি বার্তা বহন করছে। এটি প্রমাণ করে, তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তির বাইরে গিয়ে নতুন নেতৃত্বে আস্থা রাখছে। এ ফলাফল মূলত আগামী দিনের ক্ষমতার কাঠামোর একটি ক্ষুদ্র ঝলক। এছাড়া ভোটারদের বিষয়টাও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, এই বিপুলসংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী যারা ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটকে নির্বাচিত করেছেন তারাই আগামীতে সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিকসহ জাতীয় নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবেন।
সম্ভাবনা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান, সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় নতুন মডেল দাঁড় করানোর অনন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের সামনে। যদি তারা তাদের দেয়া নির্বাচনি ইশতেহারগুলো পূরণ করতে পারে, শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদাসমূহ নিশ্চিত করতে পারে তবে তাদের জনপ্রিয়তা আরও সুদৃঢ় হবে। একইসঙ্গে, গবেষণা ও নতুন চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করে তারা নিজেদের একটি জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্বে রূপান্তরিত করতে পারে।
চ্যালেঞ্জ: জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে ডাকসুর নেতৃত্ব প্রায়শই ব্যবহৃত হয়েছে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে। ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ যদি কেবল রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, তবে তারা শিক্ষার্থীদের আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এছাড়া নারী নেতৃত্বকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা, জোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখা তাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
সবশেষে, ডাকসুর ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের এই সূচনা শুধু বিজয়ীদের জন্য নয়, সমগ্র শিক্ষার্থী সমাজের। এই সুযোগকে যদি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজে লাগানো যায়, তবে তা জাতীয় রাজনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এখন দেখা যাক, ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট কতটা দূরদর্শিতা ও সততার সঙ্গে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে। শিক্ষার্থী সমাজের আশা ও আস্থা রক্ষা করতে তাদের সততা, জবাবদিহিতা ও সহিংসতামুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা হবে প্রধান কাজ।